ছবি: ইন্টারনেট



বর্তমান বিশ্ব হঠাৎ করেই থেমে গেলো একটি নতুন আতঙ্কের কারণে,যার নাম ‘করোনা’। কিন্তু এই পৃথিবীতে করোনার আবির্ভাব নতুন নয়। যদি ইতিহাস ঘাটি তাহলে এর অস্তিত্ব দেখা যায়।ষাটের দশকের শেষ দিকে প্রথম আবিষ্কৃত হয় করোনা ভাইরাস ফ্যামিলি। ‘ক্রাউন’ বা মুকুট শব্দ থেকে ‘করোনা’ শব্দটির উৎপত্তি। ভাইরাসের নামকরণ এর গঠনগত বৈশিষ্ট্যের কারণেই। সারস কোভ-১ (SARS CoV-1), সারস কোভ-২ (SARS CoV-2), মারস কোভ (MERS CoV), এইচ কোভ(H CoV) সহ আরও অনেক ভাইরাস এই গোত্রেরই অন্তর্গত। করোনা ভাইরাস ফ্যামিলি মূলত ম্যামালস বা স্তন্যপায়ীদের ও পাখির শ্বাসনালীতে সংক্রমণ ঘটায় এবং মানবদেহে সাধারণ সর্দি-কাশির (Common cold) সৃষ্টি করে থাকে।


জীবজগতের প্রত্যেকটি সত্তার গঠন ও কাজের একক হচ্ছে কোষ বা সেল(Cell)। এই কোষের যাবতীয় কাজ নির্ধারণ করে বংশগতির ধারক ও বাহক, জিন(Gene)। অর্থাৎ, একটি জীব তার পূর্বপুরুষ থেকে কী বৈশিষ্ট্য পাবে, কতটুকু পাবে, কতটুকু পরবর্তী প্রজন্মে প্রকাশ করবে, সবই নির্ধারণ করে এই ‘জিন’।


ভাইরাসের ক্ষেত্রেও তাই। ভাইরাসের গঠন কিংবা কাজ নির্ধারিত হয় এই ‘জিন’ দিয়েই। এক্ষেত্রে বলে রাখা উচিৎ, ভাইরাস কিন্তু জীব নয়, আবার জড়ও নয়; জীব ও জড়ের মধ্যে একটি ব্রিজ বলা যায়। শুধুমাত্র জীবদেহে অবস্থানকালেই জীবের মত আচরণ করে এবং বংশবিস্তার করতে পারে। তবে ভাইরাসের প্রজাতিভেদে কিছু সময়ের জন্য নির্দিষ্ট কিছু জড় বাহকেও জীবিত থাকতে পারে।

জিনগুলোর বিন্যাস যে সবসময় পূর্বপুরুষের অনুরূপ হবে তা কিন্তু নয়। বিভিন্ন ফ্যাক্টরের প্রভাবে জিনের বিন্যাসে পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তনকে বলা হয় মিউটেশন(Mutation). মিউটেশনের ফলে জীব-কোষের কার্যকরী বা গঠনগত পরিবর্তন ঘটে। এভাবেই বিভিন্ন জীবের অভিযোজন ঘটে, প্রজাতির বিবর্তন হয়। অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়, আবার নতুন প্রজাতির উদ্ভব হয়।


করোনা ভাইরাস ফ্যামিলিকে সাধারণত ৪টি ভাগে ভাগ করা যায়- আলফা, বিটা, গামা, ডেল্টা। আলফা এবং বিটা করোনা ভাইরাসের বাহক বা হোস্ট(Host) হচ্ছে বাদুড়। সারস-কোভ ২ (SARS-CoV 2) দীর্ঘকাল ধরে বাদুড়ের সাথে জড়িত থাকার ফলশ্রুতিতে সারস-কোভ এর পূর্বপুরুষরা সিভেটে (Civet; এক ধরনের সরীসৃপ) ছড়িয়ে পড়ে এবং অবশেষে মানবদেহে প্রবাহিত হয়। এক্ষেত্রে মতবিরোধ আছে যে, অন্তর্বর্তীকালীন বাহক বা ইন্টারমিডিয়েট হোস্ট হিসেবে সাপ বা প্যাঙ্গোলিন (Pangolin; এক ধরনের ম্যামাল বা স্তন্যপায়ী) ও কাজ করে থাকতে পারে। সম্প্রতি প্যাঙ্গোলিনের অন্তর্ভুক্তি যাচাইয়ের জন্য সাউথ চায়না এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটি ১০০০ ওয়াইল্ড টাইপ মেটা-জিনোম স্যাম্পলের বিশ্লেষণ করে এবং আক্রান্তদের ভাইরাস জিনোমের সাথে ৯৯% মিল পায়।


সময়ের সাথে, বিভিন্ন বাহকে অবস্থানকালে এই ভাইরাসের জেনেটিক মিউটেশন ঘটেছে, যা ভাইরাস ফ্যামিলিটিকে পূর্বের তুলনায় অনেকগুণ শক্তিশালী করে তুলেছে। জিনের বিন্যাসের পরিবর্তনের ফলে পূর্বের ব্যবহৃত ওষুধও আর কাজে দিচ্ছে না। কেননা, ভ্যাক্সিন বা ওষুধের কাজ করার ক্ষেত্র ও প্রক্রিয়া ভাইরাস-দেহের গঠন ও অভ্যন্তরীণ জেনেটিক বিন্যাসের জন্য সুনির্দিষ্ট। উপরন্তু, করোনা ভাইরাস বাতাসে ছড়ায়; এরোসল বা ড্রপ-লেট আকারে এরা ৩০ মিনিট বা তার বেশি সময় বাতাসে টিকে থাকতে পারে। তাই আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি থেকে ভাইরাসের সংক্রমণের হার অনেক বেশি। আবার, বিভিন্ন জড় বস্তুর পৃষ্ঠতলেও বেশ কিছু সময় বেঁচে থাকতে পারে; কার্ড-বোর্ডে ২৪ ঘণ্টা এবং প্লাস্টিকে বা স্টিলে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত টিকে থাকে। অর্থাৎ, দ্রুত সংক্রমণ এবং তাৎক্ষণিক ভ্যাক্সিনের অভাবই কোভিডে আক্রান্ত ব্যক্তিকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়ার ও আতঙ্ক সৃষ্টির মূল কারণ। তবে সংক্রমণের হার কমানো আর নিজের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটিকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে এই ভাইরাসকে বাগে আনা যায়। 


করোনা ভাইরাস সংক্রমণ হ্রাসে করণীয়:

১. প্রয়োজন ছাড়া বাড়ীর বাইরে যাওয়া যাবে না। একান্তই ঘর থেকে বেরুনোর দরকার হলে, অবশ্যই মাস্ক পরিধান করতে হবে এবং সকলের সাথে ন্যুনতম ও ২ মিটারের নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।

২. বাহির থেকে এসে অবশ্যই সাবান দিয়ে ভালো করে হাতমুখ ধুতে হবে। কোনোভাবেই হাত না ধুয়ে মুখমণ্ডলের কাছে নেয়া যাবে না, কারণ নাক-চোখ-মুখের মাধ্যমেই ভাইরাস মানবদেহে প্রবেশ করে।

৩. বাড়ীর বাইরে থাকাকালীন মুখের কাছে হাত নেয়ার প্রয়োজন পড়লে হাতের কাছে স্যানিটাইজার বা স্যাভলন রাখতে হবে এবং তা দিয়ে ভালোভাবে হাত পরিষ্কার করে নিতে হবে।

৪. যাদের শ্বাসকষ্ট-জনিত সমস্যা আছে, যেমন- অ্যাজমা (Asthma) বা হাঁপানি, সিস্টিক ফাইব্রোসিস, নিউমোনিয়া, ফুসফুসের ক্যান্সার, সিওপিডি (COPD; chronic obstructive pulmonary disease), তাদের কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা বেশি। এধরনের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে কঠোর হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে।

৫. কোভিডের উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত হট-লাইনে চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করতে হবে; হুট-হাট হাসপাতালে গিয়ে ভিড় করলে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়বে।

৬. কোভিডে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সংক্রমণ প্রতিরোধে সর্বক্ষণ মাস্ক পরিধান করতে হবে এবং কোয়ারেন্টাইনে অবস্থান করতে হবে।

৭. আক্রান্ত ব্যক্তিকে যথাসম্ভব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা (Personal hygiene) বজায় রাখতে হবে এবং পরিবারের সুস্থ ব্যক্তিদের থেকে আলাদা বা আইসোলেটেড অবস্থায় থাকতে হবে। সাধারণত দেহে করোনার উপস্থিতি শনাক্ত হওয়ার পর থেকে ১২ সপ্তাহ পর্যন্ত আইসোলেটেড থাকার পরামর্শ দেয়া হয়।


রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে আমাদের কিছু বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে।

১. প্রতিদিনের খাবারে সুষম খাদ্যতালিকা তথা শর্করা, আমিষ, তেল, পানি, খনিজ-লবণ ও ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবারের পরিমিত উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে।

 ২. ভিটামিন রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক। গাজর, টমেটো, সবুজ শাকসবজি, কুমড়া, ফলমূল ইত্যাদি ভিটামিনের প্রাকৃতিক উৎস। বিশেষ করে, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল, যেমন- লেবু, কমলা, আমলকী তে এসিডিটি বেশি থাকায় তা ‘এন্টিভাইরাল এক্টিভিটি’ প্রকাশ করে। তাই প্রয়োজনে বিভিন্ন ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা যায়।

৩. ১০ বছর বয়সের কম বাচ্চাদের এবং বৃদ্ধদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক কম থাকায় তাদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। তাই তাদের খাদ্যতালিকার উপর বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণের প্রয়োজন।

৪. কোভিড রোগীর সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিকেও নিজের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি কমাতে সর্বোচ্চ সচেতনতা বজায় রাখতে হবে।

রোগ প্রতিরোধের জন্য বিজ্ঞানীরা নানারকম চেষ্টা করে যাচ্ছেন । কিছুদিন আগেও প্রতিষেধক নিয়ে নানা ধরনের গুজব ছড়িয়েছে। করোনা প্রতিরোধে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।কেননা এটি এমন এক ব্যধি ্যা কখন কিভাবে ছড়িয়ে পরে বলা মুশকিল।


আরও পড়ুন 

হার্টে ব্লক কেন হয়

এক ধরনের মানসিক অবসাদ

পেটে সমস্যা থেকে মস্তিষ্কের মরণব্যধি

1 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন